দেবস্মিতা নাগ
বাঙালির রেস্তোরাঁ অভিযান আর ‘চাইনিজ’ খাওয়া প্রায় সমার্থক। একটা সন্ধে বাইরে বেরিয়ে একটু অন্যরকম খাওয়া দাওয়া বলতে অধিকাংশ বাঙালি ‘চাইনিজ’ খাওয়াকেই বোঝেন। এই বোঝাপড়াটা কিন্তু আজকের নয়, এর বয়স শতাব্দী পেরিয়েছে। একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে আনন্দ অনুষ্ঠানে চিনে খাবারকে সঙ্গী করে বাঙালির চলার পথের সাক্ষ্য ছিল নানকিং, হউ হুয়া ও চাং ওয়ার মত বহু রেস্তোরাঁ। কিন্তু কালের প্রবাহে ভেসে এরা আজ আর কেউ নেই। রয়ে গেছে শুধু ১২ নম্বর গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউর ইউ চিউ (Eau Chew)।
সেই ১৯২৭ থেকে টানা এই ২০২১ পর্যন্ত টানা বাঙালির রসনা তৃপ্ত করে আসছে এই রেস্তোরাঁ। শুধু বাঙালি কেন, একসময় এই রেস্তোরাঁর সন্ধেগুলো জমজমাট হয়ে থাকতো ব্রিটিশদের ভিড়ে। তখন এখানে ব্রিটিশদের মনপসন্দ খানাও মিলতো। ইন্দো-ইউরোপীয় খদ্দেরদের জন্য কাটলেট, পর্ক চপ ইত্যাদি রাখা হতো দোকানে।
১৯২২ সালে সুদূর চিনদেশের মই ইয়েন গ্রামের এক দম্পতি এই শহরে এসে ছোট্ট একটি সস্তা চিনে খাবারের দোকান খোলেন কলকাতার বো ব্যারাকের কাছে। সেই দোকানই কলেবরে বড় হয়ে আজকের ইউ চিউ, যার অর্থ ‘ইউরোপ ইন ম্যান্ডারিন’। মূলত বিলিতি খদ্দেরদের কথা মাথায় রেখেই এই নামকরণ। গোড়ায় ইউ চিউ-র খদ্দেররা ছিলেন শুধুমাত্র চিনের অভিবাসিত জনগণ। ক্রমেই ইউরোপীয়দের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রেস্তোরাঁটি।তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি নিজের করে নিয়েছে প্রায় শতাব্দী প্রাচীন রেস্তোরাঁকে। সঙ্গত কারণেই দোকানটি ‘ইনট্যাক’-এর দেওয়া হেরিটেজ সম্মানের দাবিদার।
দোকানের প্রসিদ্ধ খাবার দাবারের মধ্যে অন্যতম হল, চিমনি স্যুপ, চিকেন হানি-লেমন, চিলি চিকেন, চিলি পর্ক, ফিস ইন চিলি ব্ল্যাক বিন, জোসেফাইন্স নুডলস ইত্যাদি। এর মধ্যে চিমনি স্যুপই হল এই দোকানের সিগনেচার ডিশ। এই চিনদেশের আটপৌরে খাবার। একটি প্লেটে স্যুপ পরিবেশিত হয়, প্লেটের মাঝখানে একটি পাত্রে থাকে জ্বলন্ত অঙ্গার। পরিবেশনের সময় স্যুপটি সম্পূর্ণ রান্না অবস্থায় থাকে না। ধীরে ধীরে খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি প্রস্তুত হতে থাকে।
বর্তমান মালিক হুয়াং বললেন, লাইসেন্সের সমস্যার জন্য ‘cooking on the table’ পদ্ধতি বাতিল করে পুরোপুরি প্রস্তুত স্যুপ পরিবেশন করতে হচ্ছে। এই স্যুপ খাওয়া ভরপেট খাবার খাওয়ার সামিল। এতে থাকে ডিম, চিকেন, পর্ক, সব্জি, মাছ সহ আরও নানাবিধ উপকরণ। সবকটি উপকরণ মিলে এক অনবদ্য অনাস্বাদিত স্বাদ তৈরি হয়। এক প্লেট স্যুপ প্রাপ্তবয়স্ক ৩ থেকে ৪ জনের জন্য যথেষ্ট। এর সঙ্গে চিকেন সুইমাই খাওয়া যেতে পারে। এটি বিশেষ ধরনের ডাম্পলিং। তবে সাইড ডিশের মধ্যে সেরা হল ফিস ইন চিলি ব্ল্যাক বিন। মিষ্টি জলের ভেটকি ঝলসে এটি বানানো হয়। এই দোকানের সোয়াসসের স্বাদ একবারে বিরল বললে চলে।
দোকানের অন্দরসজ্জায় কোনো বিশেষ চমক নেই। সাধারণ চেয়ার টেবিলে বসে জন্য ৫৫ জন লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা। ভিতরে A C রয়েছে। দোকানের বিশেষত্ব হল বর্তমান মালিক হমিঃ ডরেন হুয়াং ও মিস জোয়েল হুয়াং-এর আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার।এঁরা হলেন সুপ্রাচীন এই দোকানের চতুর্থ প্রজন্মের মালিক। পরিবারের সদস্যরা মিলেই দোকানের রান্না বান্না করেন।
দোকানের বহিরঙ্গের সাজগোজ একেবারেই নজরকাড়া নয়। পাশ দিয়ে চলে গেলে চোখে নাও পড়তে পারে। কিন্তু এক ঝলক চোখ পড়ে গেলে ফেলে আসা সময়কে দেখতে পাওয়া যায়। দোকানের লম্বা সিঁড়িতে যেন একটা গোটা শতাব্দী স্তব্ধ হয়ে আছে।