হোমবিনোদনকবি তার জন্য গল্প

কবি তার জন্য গল্প

কবি তার জন্য গল্প

নীলার্ণব চক্রবর্তী

ট্রেন এসে দাঁড়াল স্টেশনে। কোভিডের দিনগুলি শেষ হয়েছে। ভ্যাকসিন এসেছে ঘরে ঘরে। ট্রেন চালু হয়েছে কয়েক দিন হল। তবে ট্রেনে আগের মতো ভিড় হচ্ছে না। ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা দল দুদ্দাড় করে উঠে এল। ছেলে-মেয়ে মেশানো দলে। একটি সিনেমা দেখতে ‌যাচ্ছে। সিনেমার নাম– কবি তার জন্য। শহরের প্রায় সব মাল্টিপ্লেক্সে এসেছে। সিঙ্গল প্লেক্সেও এসেছে এই ছবি।

নাহ এরা কেউ কোট-আনকোট লেখক কবি নয়। ফেসবুকের জমানায় এরা সবাই ফেসবুকে লেখালিখি করে। মাঝে মাঝে সেখানে কবিতাও লেখে। লাইক আর কমেন্ট পড়ে। ফেসবুকের হাইপাওয়ার ম্যাগনিফাইং গ্লাসে তারা কবি-লেখক। জীবনও বেশ মজাদার এই ভাবে। ট্রেন ছেড়েছে সুভাষগ্রাম স্টেশন থেকে। খুব স্লো ‌যাচ্ছে। কম্পার্টমেন্টে শোনা ‌যাচ্ছে ঘোষণা, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভ্যাকসিন নিয়েছেন তো? ‌ভ্যাকসিন না নেওয়া থাকলে দয়া করে ট্রেনে উঠবেন না। প্রতিষেধকের সার্টিফিকেট থাকাটা বাধ্যতামূলক। সার্টিফিকেট সঙ্গে রাখুন। না থাকলে জরিমানা হবে।

এই দলটার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে দুজনের ভ্যাকসিন দেওয়া নেই। এতে অবশ্য কিছু ‌যায়-আসে না, তারা খুব ডেয়ারিং। বাকিরা বাড়ির চাপে ভ্যাকসিন নিয়েছে। আসলে তাদের বাড়িতে বা আত্মীয়দের মধ্যে কারওর করোনা হয়েছিল, তাই…। কবি তার জন্য– সিনেমার টিকিট কাটা অনলাইনে। সাত দিন আগেই এই প্রয়োজনীয় কাজটি সারা হয়েছে। তা ছাড়া উপায়ও ছিল না কিছু। হুহু করে টিকিট বুক হয়ে ‌যাচ্ছে। দু-তিন দিন আগে না চেষ্টা করলে এতগুলো টিকিট এক সঙ্গে পাওয়া ‌যেত না। ট্রেনটা সোনারপুর স্টেশনে পৌঁছাল। সুভাষগ্রামের পরের স্টেশন সোনারপুর। ঝাঁকড়া চুলের একটি মেয়ে উঠল। একটা হালকা সবুজ রঙের চুরিদার পরে আছে। হাতে একটা বই, হার্ড কভার, কিন্তু বোঝা ‌যাচ্ছে না নাম। একটি সিটে বসে বইটা খুলল। মেয়েটিক কাঁধে ব্যাগ।

ট্রেনের দেওয়ালগুলিতে বেশ কয়েকটা পোস্টার। নাহ, মলিন নয়, ঝকঝক করছে। মানে সদ্য লাগানো। দুটো করে চোখ রয়েছে প্রতি পোস্টারে। কার চোখ এগুলো? চোখগুলো ওই মেয়েটাকে দেখছে। মেয়েটার ঠিক মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। ফ্যান থেকে সামান্য হাওয়া এসে মাটিতে পড়ছে। মাটিতে ছড়ানো কয়েকটা পরিত্যক্ত কাগজে ধাক্কা দিচ্ছে হাওয়া।
মেয়েটি বইয়ের পরের পাতা ওল্টাল। তারপর পরের স্টেশন এসে গিয়েছে। নরেন্দ্রপুর। একটা ভারী লোক উঠল। রাজপ্রাসাদের মতো তার নিতম্ব। ধপ করে মেয়েটার পাশে বসল। লোকটার গা থেকে ক্যারম বোর্ডের গন্ধ বেরুচ্ছে। সে কি ক্যারম খেলে এল নাকি? তার পকেটে একটা ব্যাজ ঝোলানো রয়েছে। ব্যাজে লেখা— ভাইভাই সংঘ, রক্তদান জীবনদান। লোকটা ট্রেনে উঠে ঘুমিয়ে পড়ল। কট করে ব্যাজের সেফটিপিন খুলে গেল। এই কট শব্দে ট্রেনের ফ্যানটাও বন্ধ হয়ে গেল। সেফটিপিনটা কি ফ্যানের সুইচ?

ট্রেনটা তার পরের স্টেশন, তার পরের, তারও পরের স্টেশন পেরিয়ে গিয়ে একটা সিনেমা হলের সামনে দাঁড়াল। সিনেমা‌যাত্রীরা হড়হড় করে ডায়েরিয়া হয়ে নেমে গেল ট্রেন থেকে। ‌যাওয়ার সময় তাদেরই একজন ছিঁড়ে নিয়ে গেল চোখ আঁকা একটা পোস্টার।

মেয়েটার চোখে একটু চাপ লাগল। অনেক ক্ষণ ধরে সে বই পড়ছে। ভরী নিতম্ব ভাইভাই সংঘ-ও নেমে গিয়েছে। পাশে যে বসেছে তাকে মেয়েটি চেনে, তার বাবার বন্ধু। ছোটবেলায় কোলে উঠেছে। ভদ্রলোক সব ভুলে গিয়েছেন ট্রেনে ওঠার আগে, তাই মেয়েটিকে তিনি চিনতে পারছেন না। মেয়েটা বইটা বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর মোবাইল বার করল, গুগলে টাইপ করল, স্মৃতি ফেরানোর উপায়? হাউ টু রিস্টোর মেমোরি?

তারপর ব্যাগের ভিতর থেকে একটা ছোট হাতুড়ি বার করে আনল।

  • কী সুন্দর পাখি!
    জানালার দিকে তাকিয়ে বলে উঠতেই লোকটা সেই দিকে তাকিয়ে ফেলল এক ঝটকায়। মেয়েটা এই সু‌যোগে তার মাথায় ছোট হাতুড়ি দিয়ে টুক করে মারল। আর সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতি ফিরে এল। বন্ধুর মেয়েকেও চিনতে পারল ওই লোকটা। এবং মেয়েটির হাতে দশ টাকা দিয়ে বলল, কিছু খেতে।
  • দশ টাকায় কিছুই হয় না কাকু।
    রিনরিন করে বেজে উঠল মেয়েটার গলা।

কবি তার জন্য সিনেমা দেখা হয়ে গিয়েছে ছেলেগুলোর। ছবি দেখার পর মোবাইল ছুড়ে ভেঙে ফেলেছে অনেকেই।
যারা মোবাইল ছুড়ে ভাঙেনি, তাদেরই একজন ফোন করে দিয়েছে ট্রেনের ড্রাইভারকে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হলের সামনে আসছে ট্রেনটা। আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ‌যেতে হবে। কাল উস্রি নদীর ঝরনা দেখতে ‌যাবে এরা।

**
ছবি : কবি তার জন্য। ভূমিকায় রাহুল পুরকায়স্থ, অয়ন চক্রবর্তী, জয়দীপ রাউত প্রমুখ। পরিচালক: অভ্রদীপ ঘটক।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img