হোমসাহিত্য-সংস্কৃতিশান্তিনিকেতনে গোশালা, উদ্যোগী ছিলেন স্বয়ং কবিগুরু

শান্তিনিকেতনে গোশালা, উদ্যোগী ছিলেন স্বয়ং কবিগুরু

শান্তিনিকেতনে গোশালা, উদ্যোগী ছিলেন স্বয়ং কবিগুরু

purnendu vikas sarkarডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার

শান্তিনিকেতনে গোশালা? হ্যাঁ, ১৯১০ সালে রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে সন্তোষচন্দ্র মজুমদার শান্তিনিকেতনে একটি গোশালার পত্তন করেছিলেন। বন্ধু শ্রীশচন্দ্রের পুত্র সন্তোষচন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৬ সালে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গেই আমেরিকার পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষার জন্য। রবীন্দ্রনাথের আশা ছিল দুজনে ফিরে এসে শান্তিনিকেতন ও সুরুল উন্নয়নের কাজে হাত লাগাবেন।

১৯০৮ সালের নভেম্বর মাসে শ্রীশচন্দ্রের মৃত্যুর হলে, বিরাট সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে সন্তোষের ঘাড়ে। তাই তিনি রথীন্দ্রনাথের আগেই (১৯০৯ সালের ডিসেম্বর) দেশে ফিরে আসেন। এবার সংসার চালানোর জন্য দরকার কোনো একটি স্থায়ী কাজের। সন্তোষচন্দ্র স্থির করলেন চাকরির বদলে শান্তিনিকেতনে একটি গোশালা খুলবেন আর সেখানের উৎপণ্য দুধ বিক্রি করে সংসারের চাকা সচল রাখবেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রস্তাব রাখতেই তিনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন।

তখন ব্রহ্মাচর্যাশ্রমে ছাত্র সংখ্যা প্রায় ১২০ জন। সকলেই নেহাত বালক। তাদের জন্য পর্যাপ্ত দুধ জোগাড় করাই ছিল এক বিরাট সমস্যা। রবীন্দ্রনাথের অনুমতি পেয়ে সন্তোষ প্রায় হাজার টাকা খরচ করে পাঁচটা গরু কিনে বোলপুর স্কুলেই পুরোদমে গোশালার ব্যবসা শুরু করে দিলেন। লাভও মন্দ হচ্ছিল না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “যে রকম হিসাব করা যাচ্ছে তাতে দেখতে পাচ্ছি বোলপুরেই অতি সহজে মাসিক দুশো টাকা লাভের কাজ করতে পারবে। এমন স্থলে কোনো কোম্পানীর অধীনে চাকরিতে প্রবৃত্ত হওয়ায় কি সুবিধা হবে?”

ইতিমধ্যে উপেন্দ্র সেনের ভাইঝির সঙ্গে সন্তোষের বিয়ের প্রস্তাব এল রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ ভাবলেন এই বিয়ে উপলক্ষে সন্তোষ যে আট-দশ হাজার টাকা যৌতুক পাবে, তাই দিয়ে ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। অবশ্য এই বিয়ের ব্যাপারে সন্তোষের কোনো উৎসাহ ছিল না।

শান্তিনিকেতনের মত রুক্ষ অঞ্চলে গরুপালন করা যে কত অসুবিধাজনক কিছুদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ তা বুঝতে পেরেছিলেন। নগেন্দ্রনাথকে লিখেছেন, “বোলপুরে গরু রাখার বিস্তর অসুবিধা – ঘাস নেই, গোরুর অন্যান্য খাবারও বহুদূর থেকে বেশী দাম দিয়ে আনিয়ে নিতে হয়। তবু দেখা যাচ্ছে লোকসান হবার আশঙ্কা নেই। আর যদি গোটা দশেক গরু আনা যায় তাহলে ঐ জায়গাতেই ১৫০। ২০০ টাকা মাসে খরচ বাদে পাওয়া যেতে পারে। এটা বেশ দেখা যাচ্ছে চাষের চেয়ে আমাদের দেশে গোরুর ব্যবসা অনেক বেশী লাভজনক।”

শুধু গরু নয়, ছাগলও কিনতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ আশ্রমের ছেলেদের পুষ্টির কথা ভেবে। এজন্য চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে চিন্তামণি ঘোষকে কিছু ছাগল পাঠাতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আর এটাও বলেছিলেন যে “এক ট্রাক নিতেও আমাদের আপত্তি নেই।” গরুর খাবার আর দুধ দুইবার গোয়ালার জন্য ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালের কাছে আবেদন জানিয়ে লিখেছেন, “ভূষি এখানে পাওয়া যায় না – গোয়ালাও নাই – বড় মুশকিলে পড়া গেছে। ভূষি আপনাদের অঞ্চলের যদি সস্তায় পাওয়া যায় তবে আপনার সাহায্যে আনাইব। দর কত? গোয়ালা ওখান হইতে জন দুই কি পাওয়া যায় না?”

আবার সুপুরের জমিদারের কাছ থেকে প্রায় ২০০ বিঘা জমি সন্তোষকে অল্প দামে কিনিয়ে দিয়েছেন। আশা ছিল এই জমিতে গরুর খাবার উৎপাদন করা হবে। এইসব উদ্যোগ থেকে বোঝা যায় সন্তোষের প্রকল্পের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে কতটা একাত্ম করে নিয়েছিলেন এবং সেটা বাস্তবায়িত করতে তিনি কতখানি আগ্রহী ছিলেন।

সন্তোষচন্দ্রের গোশালার কল্যাণে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের দুধের সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছিল। তবে তা সাময়িক। প্রথমদিকে কিছুটা লাভের মুখ দেখলেও কালক্রমে অর্থ-সংকটের কারণে বিদ্যালয়ের পক্ষে এই গোশালা চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। অবশেষে একদিন রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের গোশালা-প্রকল্প শান্তিনিকেতনের মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে গেল।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img