হোমআন্তর্জাতিক২৫ বারের বেশি 'পথের পাঁচালী' দেখেছিলেন এক বিশ্ববন্দিত পরিচালক

২৫ বারের বেশি ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছিলেন এক বিশ্ববন্দিত পরিচালক

২৫ বারের বেশি ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছিলেন এক বিশ্ববন্দিত পরিচালক

bikash palড. বিকাশ পাল, লন্ডন

“দ্যাখোরে, নয়ন মেলে
জগতের বাহার,
দিনের আলোয় কাটে অন্ধকার”

আজ সকালে পার্কে হাঁটছিলাম, মেঘের আড়ালে সকালের সূর্যকে দেখলাম, ছবিটি তুললাম, আর গুপি গাইন বাঘা বায়েন-এর এই গানটি মনে এলো। খেয়াল হোল, আজ তো ২ মে, এই সিনেমার পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের জন্ম দিন। মে মাসের প্রথম আর শেষ সোমবার মহারানি তাঁর রাজ্যপাটে মানুষকে কাজের থেকে ফি বছর রেহাই দিয়ে থাকেন। তাই আমারও আজ কারোর সাথে মিটিং নেই। অবশ্য খুব একটা ঢিলে অবসরও নেই, তাও ভাবলাম বিশ্ব সিনেমার এই বিরাট ব্যক্তিত্বের জন্মদিনে তাঁকে আমি যেভাবে দেখি বা বুঝি সে নিয়ে দু চার কথা লিখলে কেমন হয়।

আমি সিনেমার জগতের মানুষ নই। খুব বেশি সিনেমাও আমার দেখা হয়নি। কাজেই সিনেমার পরিচালক তো দূরের কথা, সিনেমার সমালোচকদের ব্যাপারেও কথা বলার মত জ্ঞান বা  ধৃষ্টতা আমার নেই। তবুও আজ নিজের ভাবনা থেকে কিছু লিখছি। আমার বন্ধু সাহানা সেনগুপ্ত খুব গুণি মানুষ। বলতে পারেন, তাঁর জোরাজুরিতেই আমার এই লেখা।

আমি তখন বেঙ্গালুরুতে  ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর ছাত্র। একদিন  শ্যাম বেনেগাল এলেন স্পিকমাকের অনুষ্ঠানে। ভারতীয় সিনেমার বিবর্তনের ওপর বলছেন। সত্যজিৎবাবুর সিনেমার ভাবনার ওপর প্রশংসার সাথে সাথে কিছুটা প্রতিকূল টিপ্পনীও করতে শুনলাম। মনে হল বলতে চাইছেন রায়ের শুরুর দিকের ছবিগুলির ভাবনাগুলি ভালো কিন্তু কোথায় যেন সাম্প্রতিক সমাজের সমস্যা আর প্রেক্ষাপটের পুরো প্রতিফলন  হয়নি। মানে  সত্যজিৎবাবুর ছবি সমসাময়িক সমাজের শ্রেণী সংগ্রামের কথা  খুব একটা তুলে ধরছে  না। তাই তাঁর ছবি ভবিষ্যতে যতখানি সিনেমার ঐতিহ্য হয়ে থাকবে, হয়ত  ততখানি দেশের সম্পদ হয়ে থাকবে না। বেনেগালের বক্তব্যের সার কথাটি এই রকমই ছিল, অন্তত সেই বয়েসে সেদিন আমি ওভাবেই বুঝেছিলাম ।  

তবে সত্যজিৎবাবুর যে কয়েকটা সিনেমা দেখেছি অনেকগুলিতেই  কাহিনীর সমকালীনতা আমার ভাবনাতে  ধরা পড়েছে, সিনেমাটিক  ভ্যালু  চিরকালের  কিনা, তার বিচার তো সালতামামি করবে। তবে আমার ছেলে মেয়ের জন্ম, বেড়ে ওঠা সব বিলেতে হলেও, ওরা ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’ দেখে বেশ আনন্দ পেয়েছে। সমকালীনতার কথা বললে,  মহানগর সিনেমার কথাটিই ধরা যাক। ১৯৫০-এর দশকের কলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত জনজীবনের কঠোর বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়েছে আরতির চরিত্রে। অর্থ উপার্জনের আশায়, শ্বশুরমশাই প্রিয়গোপালের রক্ষণশীল পারিবারিক মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করে আরতি নিয়েছেন বাড়ি বাড়ি সেলাই মেশিন বিক্রির কাজ। আরতি ওটা বেচতেন সংসারের আয় বাড়ানোর জন্য। আত্মনিরভরতার জন্য ভাবেননি। পরে ভেবেছেন আত্মনির্ভরতার কথা।

স্বামী সুব্রত কাজ হারিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আরতি তাঁকে  আশা ভরসা দিয়ে চলছেন। তাঁদের সংসার একদিন স্বচ্ছল হবেই। জীবনকে আশাবাদ চালিত করছে। ঠিক সেই সময় জহরলাল, বিধান রায়ের মতো  রাষ্ট্র নেতারা  দেশে  বিদ্যুৎ, ইস্পাত শিল্প,  আইআইটি-র  মতো প্রতিষ্ঠান বানিয়ে  দেশকে স্বনির্ভর করার চেষ্টা করছেন।আমার বিবেচনায় একটি সদ্য স্বাধীন দেশের নেতাদের স্বনির্ভরতার ভাবনার সাথে সত্যজিৎ  দেশের একজন সাধারণ নাগরিকের ভাবনার মিলকে তুলে ধরেছেন ছবিতে। কেননা  দেশের স্বনির্ভরতা তখনই সম্ভব, যখন দেশের মানুষ স্বনির্ভর হতে পারবেন। মানুষকে বাদ দিয়ে তো আর  দেশ হয় না।

বেশ কিছুদিন আগে ইরানের এক সিনেমা পরিচালকের আলাপচারিতা শুনছিলাম। তিনি  মাজিদ মাজিদি। ‘চিলড্রেন অফ হেভেন’-এর মত ছবি তৈরির  কৃতিত্ব যার ঝুলিতে। ফার্সী ভাষায় ছবিটির নাম ‘বাচ্চে হয়ীয়ে অসেমান’ ছবির  গল্প একেবারে সমকালীন ঘটনা। দক্ষিণ তেহেরানে মূলতঃ গরিব মানুষদের বাস। এক গরিব বাবামায়ের  ছেলেমেয়ে, আলি  আর  জাহেরা। বোনের জুতো  সারাতে গিয়ে  আলি জুতো হারিয়ে ফেলল। তার পর কীভাবে  ভয়ে বাবা-মাকে না বলে, ভাইয়ের জুতো বোন সকালে স্কুলে পরে  যায়, বাড়িতে পৌঁছনোর  একটু আগেই ভাইকে দিয়ে দেয়। আলি  স্কুলে যায়, তবে তার দেরি হয়, সে স্কুলে বকা খায়। তাদের অভাবের সংসার। আলি তার বাবার সাথে উত্তর তেহেরানের অভিজাত অঞ্চলে কারোর বাড়িতে  বাগানের মালির কাজ করে। তেহেরানের এই উত্তর আর দক্ষিণ দুটো জায়গাতেই আমি গেছি। আমার  চোখে  মানুষের জীবনযাত্রার মানের তফাৎ সহজেই ধরা পড়েছে। একদিন জাহেরার স্কুল থেকে আলিরও জুতো হারিয়ে যায়। জাহেরা কাজের সন্ধান করে, জুতো কেনার টাকা জোগাড় করার জন্য। সবসময়  তারা জীবনে আশা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে, দারিদ্র্যকে  এভাবেই তারা মোকাবিলা করে। ভাই বোনের মধুর সম্পর্ক এভাবেই শুধু অটুটই থাকে না, এগিয়ে চলে।  মহানগরের মত এখানেও চরিত্রগুলির মধ্যে আশাবাদ  কাজ করে চলে। 

মাজিদ মাজিদির কাছে প্রশ্ন কর্তা জানতে চাইলেন:
“ভাই বোনের সম্পর্ক  কীভাবে এত সুন্দর করে তুলে ধরলেন তিনি ছবিতে?” দুটো সম্পর্কের মধ্যে এত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম  ঘটনা আর অনুভূতি, কীভাবে তাঁর ভাবনার কাছে ধরা দেয় এসব?

মাজিদি  বললেন, “আমি এজন্য সত্যজিৎ রায়ের কাছে ঋণী। আমি পথের পাঁচালী ছবিটি ২৫ বারের বেশি দেখেছি আমার কলেজ জীবনে। সেখানে অপু দুর্গার সম্পর্ককে সত্যজিৎবাবু যেভাবে তুলে ধরেছেন, সেটা আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। আমি পথের পাঁচালী ছবিটি দেখেই বাচ্চাদের জন্য ছবি তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলাম।”

মাজিদির বিবেচনায় সত্যজিতের ছবি বিশ্বের সম্পদ। বেনেগাল সেদিন কেন  অমন বলেছিলেন, এখনও তা বুঝতে পারিনি। সত্যজিতের বাংলাতে পথের পাঁচালীর ৪০ বছর পর মাজিদি ‘বাচ্চে হয়ীয়ে অসেমান’ ছবিটি  ১৯৯৫ সালে  ফার্সী ভাষাতেই বানালেন। দুজনের কেউই  নিজের ভাষার বাইরে বেরলেন না। কিন্তু বিশ্বের সব ভাষার ছেলেমেয়েরা এই ছবিগুলি দেখে আনন্দ পায়। দুটোই তো  বিশ্ববন্দিত ছবি। এ প্রসঙ্গে রবিঠাকুরের নীচের কবিতাটি  প্রাসঙ্গিকভাবেই মনে এলো,
“বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।”


এই কবিতা রবিঠাকুর একটি ছোট খাতার পাতায় লিখেছিলেন সুপ্রভা রায়ের অনুরোধে। সুপ্রভা রায় (সুকুমার রায়ের সহধর্মিনী আর সত্যজিত রায়ের মা) রবি ঠাকুরের খুব স্নেহের পাত্রী ছিলেন। সত্যজিতকে ছোট থেকেই তিনি রবিঠাকুরের শান্তিনিকেতনে নিয়ে যেতেন মাঝে মাঝে। একবার কবিকে আবদার করেছিলেন বালক সত্যজিতের জন্য একটা বাণী লিখে দিতে। সেটিই এই কবিতার ইতিহাস। কবির প্রয়াণের বহু বছর পরে সুপ্রভা রায়ের সংগ্রহ থেকে এটি রবীন্দ্র রচনাবলীতে অন্তর্ভুক্তি হয়েছে। সত্যজিৎবাবু এই কবিতার ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেজন্যই তাঁর সব সাহিত্য, কাহিনী চিত্র আর সব শিল্পকর্মই তিনি বাংলা ভাষাতেই করেছেন কিনা, জানা যায় না । অবশ্য অনেক সত্যজিৎ বিশেষজ্ঞ অনুরাগী সেরকম  মত পোষণ করেন। আজ তাঁর জন্মদিনে গঙ্গা জলেই  গঙ্গা পুজো করলাম: মহারাজা তোমারে সেলাম।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img