হোমভ্রমণনির্জনতার ডাকনাম -- গারো বস্তি

নির্জনতার ডাকনাম — গারো বস্তি

নির্জনতার ডাকনাম — গারো বস্তি

সুব্রত সরকার : বিগত কয়েক বছরে বেশ কিছু মনের মত হোম স্টে সফরে ভ্রমণের মজা বুক ভরে নিয়েছি।বুকের মধ্যে যেন তার স্বাদ-গন্ধ আজও মধুর হয়ে আছে।” মধুর মধুর ধ্বনি বাজে/ হৃদয়কমলবনমাঝে…”

এই হল আমার নিষ্পাপ অনুভূতি। প্রতিটি ভ্রমণই কত না সুক্ষ,সুন্দর সব অনুভূতির জন্ম দেয়।তাই আমার সব ভ্রমণই অনুভূতির বর্ণমালা!…

আজ তেমনই একটা একটু
অচেনা,অনেকটা অপরিচিত
হোম স্টে সফরের গল্প বলতে
আমার মত এক মুসাফিরের
কলম বড়ই আনচান করছে।

আমার ভ্রমণ কখনো একলা,কখনো দোকলা,কখনো দলবেঁধে। একলা ভ্রমণের মজা আমার
অভিজ্ঞতায় সবার সেরা। যতবার একলা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছি,পথ আমায় নতুন নতুন বন্ধু বাড়িয়ে দিয়েছে।

নিজের মর্জিতে নিজের মত করে সব কিছু চেখে দেখার যে মহানন্দ তার কোনও তুলনা হয় না।
পুব ডুয়ার্সের রাজা রাজাভাতখাওয়া। সেই রাজাভাতখাওয়া স্টেশনের রেল গেট পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি একা,এক গভীর নির্জন পথে– সে পথের শেষে জানি আছে এক অপরূপ
পান্থশালা, নাম তার গারো বস্তি।
লাল সিং ভুজেল তাঁর নিজস্ব
আস্তানায় গড়ে তুলেছেন মুসাফিরের ‘ হামরো হোম’।

গারো বস্তির এই হামরো হোম সত্যিই এক নিরিবিলিপুর। চরাচর জুড়ে কি অপরূপ শান্ত
এক নির্জনতা। মন উদাস হয়ে যায়। প্রাণে গান থাকলে গাইতেই ইচ্ছে করবে,” কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে,তখন তুমি ছিলে না মোর সনে…” আমার একলা ভ্রমণ এমন করেই ভরে থাকে রবি ঠাকুরের গানে।

লাল সিং ভুজেল বড় সুন্দর করে গড়েছেন হামরো হোম-এর কাঠ বাংলোটি। এই কাঠ বাংলোর লম্বা বারান্দার এক কোণে চুপটি করে শুধু বসে থাকলেই এ ভ্রমণ সার্থক হয়ে ওঠে।

বারান্দার সামনে অনেকটা দূরে একটা সবুজ দিগন্ত।এই দিগন্তের ওপারে বিখ্যাত সিনচুলা রেঞ্জ। ভুটান পাহাড়।

জয়গাঁ। ফুন্টসিলিং। পাশাখা। রাইমাটাং ও অপরপ্রান্তে বক্সা পাহাড়। খালি চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে সবই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা হয়ে যায়। আর দেখা যায় আলিপুরদুয়ারের সর্ব্বোচ্চ পিক ‘ পামসেলাকে’।আদরের একটা ডাকনাম আছে এই পিকটার, ‘ন্যাড়া পিক’। আলিপুরদুয়ারের পাহাড় পর্বত প্রেমী মানুষজনদের বেশ একটা অহংকার আছে এই ন্যাড়া পিককে নিয়ে।

গারো বস্তির আশপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কত পান্না,হীরে,চুণী– ডিমা নদী,আটিয়াবাড়ি চা বাগান, রাজাভাতখাওয়ার গভীর জঙ্গল, জয়ন্তী, ২৯ বস্তি, সান্তালাবাড়ি, বক্সা ফোর্ট, লেপচাখা।

গারো বস্তির লাল সিং ভুজেলের হোম স্টেতে থাকার অভিজ্ঞতা আমার কাছে অপরূপ অনন্য। আর মানুষটাও খুব আকর্ষণীয়। তাঁর সঙ্গ সুধায় সময় দিব্যি কেটে যায়। জানা হয়ে যায় স্থানীয় জনজাতি বনবাসী মানুষ জনদের রোজকার জীবনের অকথিত অনেক গল্প। সব গল্পই আমাদের মত শহুরে মানুষজনদের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা।

হামরো হোমের এই বাগানবাড়ির চারপাশ গামার, জারুল, চাপ, চিকরাশি, রুদ্রাক্ষ ও লাটোর গাছ দিয়ে ছায়া ঘেরা। সারাদিন এই সব গাছে পাখিরা নাচে,শিস দেয়,গান গেয়ে গেয়ে উড়ে বেড়ায়।পাহাড়ি ময়না,বনটিয়া আর ধনেশ ( হর্নবিল) দেখা যায় অহরহ।

গারো বস্তি কে কেন্দ্র করে বনগ্রাম আছে তিনটে,রাভা,নেপালী ও আদিবাসীদের।পায়ে হেঁটে এই সব বনগ্রাম ভ্রমণের মজাই অন্যরকম।আর সঙ্গে যদি লাল সিং ভুজেল থাকেন তো,সে ভ্রমণ গল্পের ঝুলিতে উপচে উঠবে।

হাতির বড় প্রিয় জায়গা গারো বস্তি। রাত বিরতে এখানে হাতির পাল চলে আসে। সামনেই বক্সা রির্জাভ ফরেস্ট। গভীর রাতে হামরো হোমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাতির পাল দেখার রোমহষর্ক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।

গারো বস্তি শান্ত ভ্রমণের জন্য বড় মনোরম। এর সম্পদই হল নির্জনতা। এমন এক নির্জন বনবাসে একবার এসে পড়তে পারলেই, মনের অনেক গোপন গভীর ক্ষতে শুশ্রুষার প্রলেপ পড়ে যায়। নিজ নিকেতনে ফিরে যাওয়ার সময় প্রাণে নতুন গান যেন বেজে ওঠে,” আমার মন কেমন করে/ কে জানে, কে জানে,কে জানে কাহার তরে…” এই মন কেমনের বেদনটাই গারো বস্তির অমোঘ উপহার!…

কীভাবে যাবেন— শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনকন্যায় আলিপুরদুয়ার জংশন। সেখান থেকে মাত্র ১৯ কিমি।অটো,টোটো,জিপ নিয়মিত পাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন— হামরো হোম,গারো বস্তি।
লাল সিং ভুজেল ৯৪৭৪৬২৭৮৯৩,৮০১৬৫৮৫৯৭৭,৮৩৪৫৫৯৮০৪১৩,৯৮৩২৩৬৫১২৩।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img