দেবস্মিতা নাগ : নবদ্বীপকে অনেকেই নবদ্বীপকে অনেকেই মায়াপুর, রাস, প্রাচীন মন্দির, শ্রীচৈতন্যদেবের জন্য চেনেন। কিন্তু পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের অত্যন্ত প্রিয় এই নবদ্বীপের উপকণ্ঠে রয়েছে আরেকটি অত্যাশ্চর্য ও আকর্ষণীয় হাওয়া বদলের জায়গা। সে খোঁজটা কিন্তু এখন অনেকেরই অজানা। নবদ্বীপের লাগোয়া মাহেশগঞ্জে রয়েছে একটি সুপ্রাচীন নীলকুঠি, যেটি বর্তমানে একটি হোম স্টে।
1859-এ তৈরি এই স্থাপত্যের প্রথম মালিকানা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। থাকতেন হেনরি নেসবিট স্যাভি নামে এক নীলকর সাহেব। পরবর্তীতে যখন নীলচাষ উঠে যায়, এই সম্পত্তি কিনে নেন পালচৌধুরীরা। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সম্পন্ন ব্যবসায়ী। তখন থেকেই এই অট্টালিকা ও সংলগ্ন বালখানা এস্টেট তাঁদের সম্পত্তি।
এই কুঠী এককথায় বলতে গেলে একটি প্রাসাদ। এর প্রতিটি আসবাবেই রয়েছে আভিজাত্য ও প্রাচীনত্বের ছোঁয়া। বিরাট প্রশস্ত বারান্দায় ঝোলানো আছে দোলনা। রয়েছে সাজানো বাগান, তাতে পাতা ডেক চেয়ার। মাথার উপর ছড়ানো ছাতা। সেখানে শুয়ে শুয়ে দিব্যি কোনো বইয়ের পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে ঘুমিয়ে পড়া যায়। প্রচুর নাম না জানা পাখির কলতান, প্রাসাদের শতাব্দী প্রাচীন নৈঃশব্দ্য আসূর্যাস্ত দূর করে চলেছে।
এসব কিছুই যদি ভালো না লাগে, তার জন্যে লাজরাস কাঠের ক্যারম বোর্ড রয়েছে। বিলিয়ার্ড-স্নুকারও রয়েছে। রয়েছে ডার্ট ছোঁড়ার ব্যবস্থা। রয়েছে তাস, পিংপং বলও। আর তাতেও যদি ঠিক আনন্দটা না পাওয়া যায়, এক আকাশ তারার নীচে ‘বন ফায়ার’ তো আছেই। রাতে বেশ দেরি পর্যন্ত ছাদে ঘুরে কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
খুব সকালে হাতে বাওয়া নৌকায় ভেসে যাওয়া যায় জলঙ্গির সবুজ জলে। হাতে বেশি সময় থাকলে পূর্বস্থলীর চুপির পাখিরালয় পর্যন্ত ভেসে যাওয়া যায়। সেই সরোবর হাজার হাজার বিদেশি পাখির আনাগোনায় সরগরম। সঙ্গে থাকবে শুধু জল, ক্যামেরা আর কিছু উপাদেয় খাবার। এই খাদ্যটি ছাড়া কিন্তু বিশেষত বাঙালির আনন্দ কিন্তু অসম্পূর্ণ।
এই হোম স্টে-র বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে দেশি-বিলিতি দু রকম খাবারই মেলে। এখানে যেমন কেক পুডিং রয়েছে, তেমনি রয়েছে লুচি আলুর দম। তবে এখানকার খাদ্যের বৈশিষ্ট্য হলো, উপকরণ গুলি বাজার থেকে কেনা নয়। সমস্ত উপকরণ, যেমন-ফল, সব্জী,দুধ ইত্যাদি এস্টেটের নিজস্ব উৎপাদন।
এই হোম স্টে সপ্তমী থেকে লক্ষ্মী পূজা অবধি বন্ধ থাকে। অর্থাৎ মা দুগ্গা চলে গেলে যেই ফাঁকা ফাঁকা লাগবে, বেরিয়ে পড়তে হবে নীলকুঠিতে, অন্ততপক্ষে এক রাতের জন্য। নভেম্বর থেকে মার্চ এইখানে বেড়ানোর সেরা সময়। যদিও এটি পর্যটকদের জন্য পয়লা জুলাই খুলে যায়।
হাওড়া ,শিয়ালদা,চিৎপুর যেকোনো স্টেশন থেকে নবদ্বীপ বা কৃষ্ণনগর আসতে পারলেই এখানে পৌঁছনো যাবে। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, বাড়িটি মাহেশগঞ্জ বিডিও অফিসের পাশেই। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আসতে হলে কালনা, ধাত্রীগ্রাম, সমুদ্রগড় পেরিয়ে হেমায়েতপুর মোড় থেকে ডান দিকে বাঁক নিয়ে গৌরাঙ্গ সেতু পেরিয়ে যেতে হবে। অথবা কৃষ্ণনগরের দিক থেকেও আসা যায়। সে ক্ষেত্রে সেতু পেরোনোর আগেই পড়বে বালখানা, মহেশগঞ্জ।
নীল কুঠির সাহেবের জাঁকজমকের জীবন একটিবার চেখে দেখতে আসাই যায়, এরকম একটা প্রত্ন আসবাবে মোড়া ঐতিহাসিক প্রাসাদে।