মিলন খামারিয়া ও কল্যাণ চক্রবর্তী
বাঙালির বৃটিশ স্তাবকতাকে ব্যঙ্গ করে সুকুমার রায় লিখেছিলেন, “হুঁকো মুখো হ্যাংলা/বাড়ী তার বাংলা।” এই হ্যাংলা বাঙালি বৃটিশ প্রভুর জুতো চাটতো আর বৃটিশরা তাদের ‘নেটিভ’ বলে ঘৃণা করতো।
‘বঙ্গমাতা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।”
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মতে, বাঙালি ‘মানুষ’ পদবাচ্য হয়ে উঠছে না। তাহলে ‘মানুষ’ হতে গেলে কী করতে হবে? তার বর্ণনা পাই কুসুম কুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায়,
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
‘মানুষ হইতে হবে’ – এই যার পণ৷”
এ সব বর্ণনা বাস্তব। কিন্তু কোনও কোনও বাঙালি এমনও জন্মান, যাঁরা ‘ব্যাঘ্রে-বৃষভে’ সমন্বয় ঘটান। তেমনই বঙ্গসন্তান ছিলেন বিবেকানন্দ, তেমনই ছিলেন বিনয়-বাদল-দীনেশের মতো গুপ্ত-বিপ্লবীর দল। তাঁরা শান্ত ছিলেন, ভদ্রও ছিলেন। কিন্তু নিদ্রিত ভারতকে জাগানোর আগুন ছিল তাঁদের মধ্যে, দেশপ্রেমের আগুন জ্বালানো ছিল তাঁদের প্রাণে। তাই শান্তিতে শুয়ে থাকার মানুষ তাঁরা ছিলেন না।
তাঁরা ‘পোষ-মানা’ বাঙালি ছিলেন না। ‘সুপ্ত হয়ে লুপ্ত হয়ে’ গুপ্তবাসের গৃহী-বাঙালি নন। “বোতাম-আঁটা জামার নীচে শান্তিতে শয়ান” ছিল না তাঁদের। “তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু/নিদ্রারসে ভরা” দেহও তাদের নয়। তাঁরা নিমেষে বিকট উল্লাসে সব কিছু ছিঁড়ে ছুটে যাওয়া বাঙালি; রুদ্ধ-প্রাণ মুক্ত করার বাঙালি। তাঁরা মদ্যসম পান করতে চেয়েছেন মুক্ত ভারতবর্ষের সুধা, শূন্য-ব্যোম অপরিমাণ দেশমাতৃকা চেয়েছেন।
শান্ত যুবক সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ একদিন ট্রেনে উঠে পড়েন বৃটিশদের কামরায়। কামরায় বসে ছিলেন দুজন সাদা সৈন্য। স্বামীজিকে দেখে এক সৈন্য তাঁর বুদ্ধির সমালোচনা করে বলেন, “The Ass is coming”। অন্য এক সৈন্য তাঁর শ্যামলা গাত্রবর্ণ দেখে বলেন, “No, there is a goat.”
স্বামীজি ধীর গতিতে এসে তাদের মাঝখানে বসলেন এবং দু’জনের দিকেই একবার করে তাকিয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “I am sitting between the two.” স্বজাত্যবোধ-জাত প্রতিবাদ আজকের যুবকদের শিখতে হবে তাঁর জীবনাচরণ থেকে।
৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০। রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করলেন তিন অসীম সাহসী বাঙালি। ‘অলিন্দ যুদ্ধ’-র তিন মহানায়ক সেদিন বাঙালির সংজ্ঞা-স্বরূপ দিয়েছিলেন বদলে। বিনয় বসু, যাঁর জন্ম ১৯০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। অভিযানকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২২। বাদল গুপ্ত, জন্ম ১৯১২ সালে, বয়স হয়েছিল ১৮। দীনেশচন্দ্র গুপ্ত, জন্ম ১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর, বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর।
এদের তিন জনের হাতেই পিস্তল। অত্যাচারী পুলিশ অফিসারদের সাজা দেবেন, এই প্রতিজ্ঞা। বৃটিশ পুলিশে ত্রাস জাগাতে তাঁরা মরিয়া, যাতে দেশের মানুষকে অত্যাচার করার সাহস না পায়। গোপনে গড়ে তুললেন বিপ্লবের শাখা। আগ্নেয়াস্ত্র চালনা শিখে প্রস্তুত হয়েই এলেন সাহেবী পোষাকের ছদ্মবেশে। কুখ্যাত ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পন সাহেবকে দুর্ভেদ্য রাইটার্স ভবনের মধ্যেই খতম করবেন, এই দৃঢ়তা ছিল। সুসম্পন্ন হল সেই কাজ। তারপর পুলিশের সঙ্গে চললো অসমসাহসী, ঐতিহাসিক অলিন্দ-যুদ্ধ।
রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এখনও তার অমোচ্য ইতিহাস স্মৃতি হয়ে আছে। আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ফুরোলো; কিন্তু তাঁরা ধরা দিতে চান না। বাদল গুপ্ত পটাশিয়াম সায়ানাইড খেলেন এবং অচিরেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন। বিনয় বসু নিজেকে গুলিবিদ্ধ করলেন। দীনেশও তাই করলেন। বিনয় ব্রিটিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন। দীনেশকে বাঁচিয়ে তুলে ব্রিটিশ-বিচারে ফাঁসিকাঠে ঝোলালো আদালত। তাঁরা কিন্তু আজও মরেন নি, দেশের মুক্তির ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।
রাইটার্স বিল্ডিং মানে ইংরেজ প্রশাসকের কলম-কালি পেশার দম্ভের অট্টালিকা নয়; রাইটার্স বিল্ডিং মানে কয়েক দশকের লালফিতে-সুলভ লালবাড়ির অধ্যাদেশও নয়। রাইটার্স বিল্ডিং মানে বিনয়-বাদল-দীনেশের রক্তলেখা এক হারিয়ে যাওয়া বাঙালির বীরত্বের অমর ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুরের ভূমিপুত্র ছিলেন এই তিন বাঙালি। কিন্তু বিক্রমপুর কি তাঁদের মনে রেখেছে?